Institute History

গুণাকরকাটি শাহ্‌ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া বিদ্যালয়টি সাতক্ষীরা জেলাস্থ আশাশুনি উপজেলার কুল্যা ইউনিয়নের  গুণাকরকাটি নামের যে গ্রামটি আজ শিক্ষাদীক্ষায় ইসলামিক ঐতিয্যে আলোকিত এক জনপদ তার গোড়া পত্তন হয়েছিল বৃটিশ আমলে ওলি কুল শিরোমণি হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (রঃ) আগমনে। ইমামে রব্বানী মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রঃ) হযরত শায়খ আহমদ ফারুখ সেরহেন্দী (রঃ) এর আওলাদ দিল্লীর হযরত শাহ্‌ আবুল খায়ের দেহলবী (রঃ) এর নিকট থেকে আধ্যাতিক ফয়েজ ও খেলাফত নিয়ে বাংলায় এসে তিনি গুনাকরকাটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ১৯০৭ সালে। গুনাকরকাটিতে বসবাসের সময় এলাকার মানুষ হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (রঃ) এর সান্নিধ্যে এসে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাহার সুনাম গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি এ জনপদের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য মসজিদ, মকতব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাহার ওফাতের পর তাহাকে গুনাকরকাটিতে সমাধিস্থ করা হয়। বর্তমানে তাহারই প্রতিষ্ঠায় খানকায়ে খাইরিয়া আজিজীয়া দরবার শরীফ অবস্থিত। হযরত শাহ্‌ আব্দুল আজিজ (রঃ) কতৃক আবাদ কৃত এ জনপদে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতি বেশ খানিকটা বিলম্বে শুরু হলেও পাঠশালা শিক্ষা পদ্ধতির ব্যবস্থা চালু ছিল বরাবরই। পণ্ডিত যতীন্দ্র নাথ ব্যানাজী ও পণ্ডিত হরিপদ মুখার্জি পাঠশালায় শিক্ষারথীদের পড়াশুনার কাজে রত ছিলেন।

 

গুনাকরকাটি, মাদারবাড়িয়া, মহাজনপুর, দাদপুর, বাহাদুরপুর, কুল্যা গ্রামে বিশ শতকের প্রারম্ভিক পর্যায়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল তা হলো গৃহশিক্ষার আদলে প্রচলিত পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা। পাঠশালা কেন্দ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আস্তে আস্তে সরকারী অনুমোদনের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হতে থাকে বিভিন্ন স্থানে। গুনাকরকাটিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষে এলাকার বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টা চালান। হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (রঃ) এর বড় পুত্র হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ আব্দুর রহিম (রঃ) সহ এলাকার বিদ্যোৎসাহীদের প্রচেষ্ঠায় ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গুনাকরকাটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় খাইরিয়া আজিজীয়া কামিল মাদরাসা। ১৯৯২ সালে হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (রঃ) এর ছোট পুত্র হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ জোবায়ের (রঃ) চাকরী থেকে অবসর হয়ে ঢাকা থেকে গুনাকরকাটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ সময় তিনি গুনাকরকাটিতে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য এলাকার বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তি বর্গের সাথে একাধিকবার সভা/ মিটিং করেন। ১৯৯৪ সালে গুনাকরকাটিতে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে গুনাকরকাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। উক্ত সভায় সাংবাদিক আব্দুল বারী, সাংবাদিক হাবিবুর রহমান, মোঃ ওয়াছে আল মামুন, মোঃ সিরাজুল ইসলাম, মোঃ রফিকুল ইসলাম, মোঃ ইব্রাহিম, শুকুমার মণ্ডল, তাহসিন আহম্মেদ প্রমুখ মিলিত হন কিভাবে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা যায়। এ কাজে অগ্রনী ভুমিকা পালন করে ছিলেন হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ জোবায়ের (রঃ)  সাহেব। এ ছাড়া গুনাকরকাটি সমাজ কল্যাণ সংঘ বিশেষ ভাবে সহযোগিতা করেছিল। ১৯৯৬ সালে গুনাকরকাটি দক্ষিন পাড়াস্থ মোঃ ইব্রাহিমের জমিতে ঘর তৈরী করে ছাত্র/ ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে জায়গার স্বল্পতার কারনে পরবর্তীতে গুনাকরকাটি কোদার বেড়/খালবোন নামক পুকুর পাড়ে পীর কেবলার জমিতে স্কুল স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৭ সালে কাল বৈশাখীর তান্ডব লীলায় গোলপাতা ও বাশের খুটি দ্বারা নির্মিত পাঁচ রুম বিশিষ্ট স্কুল ঘরটি ভেঙ্গে পড়লে সাময়িকভাবে পীর কেবলার বাড়িতে চট্টগ্রাম মুসাফির খানায় পড়াশুনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ইতিমধ্যে স্থায়ীভাবে হাইস্কুলটি প্রতিষ্ঠার লক্ষে সরকারী নীতিমালার আলোকে স্কুলের স্বনামে জমি রেজিস্ট্রি প্রয়োজন দেখা দিলে হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (রঃ) এর চতুর্থ সাহেব জাদা হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ মাসুম (রঃ) প্রথমে বিদ্যালয়ের নামে জমি দান পত্র করে দেন। স্কুলের জন্য  জমি ও অপারাপর সম্পত্তি দান করা হলেও সরকারী চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় জমি না পাওয়ায় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

১৯৯৭ সালের আগষ্টে হযরত শাহ্‌ মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (রঃ) এর তৃতীয় সাহেব জাদা শাহ্‌ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া (রঃ) এর একমাত্র পুত্র কে এম মিন্নাত উল্লাহ (যিনি  তৎকালীন সময়ে ওয়াল্ড ব্যাংকের ওয়াটার এ্যান্ড স্যানিটেশন বিভাগের সিনিয়র অফিসার পদে চাকরীরত ছিলেন) ছুটিতে বাড়ি আসলে অত্র এলাকার বিদ্যুতসাহী ব্যক্তি বর্গ বিশেষ করে শাহ্‌ মোহাম্মদ জোবায়ের (রঃ) সাহেব সাক্ষাত করেন কে এম মিন্নাত উল্লাহ সাহেবের সাথে। তারা আবেদন জানান হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করার জন্য। কে  এম মিন্নাত উল্লাহ সাহেব সম্মত হন। সিদ্ধান্ত হয় স্কুলের মান করন হবে কে এম মিন্নাত উল্লাহ সাহেব এর পিতা শাহ্‌ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া (রঃ) এর নামানুসারে। ঐ সময় কে এম মিন্নাত উল্লাহ সাহেব স্কুলের জমি  ক্রয় ও স্কুল ঘর নির্মাণের জন্য ছয় লক্ষ টাকার একটি চেক হস্থান্তর করেন শ্রদ্ধেয় চাচা শাহ্‌ মোহাম্মদ জোবায়ের (রঃ) সাহেবের হাতে। তাৎক্ষনিক ভাবে শাহ্‌ মোহাম্মদ জোবায়ের (রঃ) সাহেবকে সভাপতি করে গঠিত হয় বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ। পরিচালনা পরিষদ পূর্বের দান কৃত ২৬ শতক জমির পাশেই আরও ১.০৯ শতক জমি ক্রয় করে ইটের দেয়াল ও টিনের সেডের  ৮০ ফুট লম্বা ২২.৫০ ফুট চওড়া মোট ৫টি কক্ষ এবং ৯০ ফুট লম্বা ২০ ফুট চওড়া ৪টি কক্ষ বাশ ও গোলপাতা দ্বারা নির্মিত ঘর তৈরী করেন। এলাকার অনেকেই বাশ সংগ্রহ ও স্কুল ঘর তৈরীর কাজে সহযোগিতা করেন। এখানে সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করেন তৎকালীন সংসদ সদস্য এস এম মোখলেছুর রহমান। ১৯৯৮ সালে ১লা জানুয়ারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে মোহাম্মদ ছাফিউল্লাহ সাহেবকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং অপরাপর শিক্ষক সহ মোট ১০ জন শিক্ষক এবং প্রায় শতাধিক ছাত্র ছাত্রী নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গ ভাবে শুরু হয়। বিদ্যালয়টি সরকারী ভাবে অনুদান ভুক্ত ও সরকারী ভাবে নিবন্ধন করার জন্য উপ পরিচালক খুলনা অঞ্চল খুলনায় যোগাযোগ করা হয়। এ ব্যাপারে এস এম মোকলেছুর রহমানের নির্দেশক্রমে মহিষাডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কার্ত্তিক চন্দ্র সরকার বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন। তারই সহযোগিতায় ০১/০১/২০০০ সাল হইতে ৩১/১২/২০০৩ সাল পর্যন্ত জুনিয়র পর্যায়ে পাঠদানের অনুমতি প্রাপ্ত হয়। ২০০৩ সালে যশোর  শিক্ষা বোর্ড বিদ্যালয় পরিদর্শন করে বিদ্যালয়ের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন ০১/০১/২০০৪ সাল হইতে পরবর্তী তিন বছরের জন্য স্বীকৃতি লাভ করে। ২০০৪ সালের মে/ জুন মাসে বিদ্যালয় এম পি ও ভুক্ত করার লক্ষে তৎকালীন সংসদ সদস্য জনাব রিয়াছাদ আলী বিশ্বাস বিদ্যালয়ের পক্ষে ডি ও লেটার প্রদান করেন। ঐ সময়ে বিদ্যাল্যটিকে এম পি ও ভুক্ত করার জন্য বিভিন্ন ভাবে প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও প্রথম পর্যায়ে এম পি ও ভুক্ত না হওয়ায় কে এম মিন্নাত উল্লাহ সাহেবের প্রচেষ্টায় ০৭/০৬/২০০৪ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জনাব বিকাশ চন্দ্র শাহার স্বাক্ষরে লিখিত পত্র মুলে বিদ্যালয়টি জুনিয়র পর্যায়ে সরকারী অনুদান ভুক্ত হয়। ২০০৫ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ড বিদ্যালয় পরিদর্শক পরিদর্শন করে স্কুলের পক্ষে মতামত করলে নবম শ্রেনীতে ছাত্রছত্রীর পাঠদানের অনুমতি লাভ করে। ২০০৬ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ড পরিদর্শক পরিদর্শন করে বিদ্যালয়ের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলে বিদ্যালয় অস্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে এবং স্বনামে ২০০৬ সাল থেকে এস এস সি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করে।

 

 

 ১৯৯৮ সালে এলাকার বিদ্যুতসাহীদের স্বপ্ন অন্তরে লাগাম করে প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন গুনাকরকাটি শাহ্‌ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তাদের সে স্বপ্ন হয়ত এখনো সফল হয়নি। তবে অনেকটা যে সার্থক হয়েছে সে সত্য ভাষন উচ্চারন করা যায় দ্বিধাহীন চিত্তে। এ বিদ্যা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে তারা আজ প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছে। তাই গুনাকরকাটি শাহ্‌ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় এখন শুধু প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি বিদ্যালয় এমনটি নয় এর ব্যপ্তি দেশময়।

লেখকঃ  

মোহাম্মদ নাজিমুদ্দীন,

সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা)